html

Saturday, April 7, 2018

ইন্দিরা দাশ

অসমাপ্ত

ইন্দিরা দাশ 


ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টটা আসবে, বুঝতে পারছিল সূর্যতপা। ফেসবুকে ভদ্রলোক বেশ কিছুদিন ধরেই তার সমস্ত পোস্ট ফলো করছেন। কোথাও কোন এক বন্ধু’রও বন্ধু’র পোস্টে কমেন্টটা করেছিল সূর্যতপা। গানটার সম্বন্ধে তার অনেক কিছু জানা ছিল। ‘পড়োসন’ ছবিতে কিশোরকুমার আর মান্না দে গানখানা গেয়েছিলেন ঠিকই, তবে তার অনেক বছর আগে ‘ঝুলা’ ছবিতে এই গানটিই গেয়েছিলেন অশোককুমার, লীলা চিটনিসের সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন সে ছবিতে উনি। লক্ষণীয় ব্যাপার এই যে সে সিনেমায় মমতাজ আলীও ছিলেন, যিনি ছিলেন ‘পড়োসন’ ছবির প্রযোজক মেহমুদ সাহেবের পিতা। পরবর্তী কালে অল্পস্বল্প লিরিক্স ও সুর বদলানোর পর এই গান ‘পড়োসন’ সিনেমা’তে ব্যাবহার হয়, আর ডি বর্মণের সুর সঞ্চালনায়। এ বিষয়টা কোথায় পড়েছিল সূর্যতপা, সে কথা সে নিজেই ভুলে গিয়েছিল। কিন্তু ফেসবুকে এই গানের গ্রুপটাতে গান-টান নিয়ে আলোচনা করতে সবাই বেশ ভালোবাসে, তাই এত কথা লিখে ফেলল সে। উচ্ছসিত প্রশংসায় মুখর হয়ে উঠেছিল অশোকেন্দু মুখার্জি। তার কিছুদিন পরে মৌমিতার দেয়ালে তাদের কলেজ রি-ইউনিয়নের পুরনো ছবিটায় ভদ্রলোক কমেন্ট করলেন। দুই-বিনুনি রোগা ছিপছিপে সূর্যতপা’কে অবাক ভাবে চিনে ফেললেন ঠিক। মৌমিতার  স্বামীর ফেসবুকের বন্ধু বোধহয়। মন্দ লাগছিল না সূর্যতপা’র। একা একা জীবন কাটাচ্ছে সে ক’বছর হোল। ফেসবুকে সমমানসিক, সমরুচিশীল কোনও মানুষের প্রশংসা ভালো লাগে, একঘেয়েমিও কাটায়।
একাকিত্বটা অবশ্য ইচ্ছাকৃত। শঙ্করের সাথে ডিভোর্সটা হয়ে যাওয়ার পর সেই ঠিক করে নিয়েছিল, অফিসের কাছাকাছি ফ্ল্যাটটাতেই থাকবে। বাপের বাড়ি উলুবেড়িয়া ফিরে যাওয়ার কোন মানেই হয়না। ডেলি-প্যাসেঞ্জারির অভ্যাসটা আবার শুরু করা আর তার পক্ষে সম্ভব হবেনা। এই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়ার পর বাবা একটু গম্ভীর হয়ে চুপ করে গেলেও, মা দুশ্চিন্তার পাহাড় মাথায় নিয়ে বসে পড়েছিলেন।  
‘কি যে বলছিস তুই তপা, এমনি করে একা একা থাকতে পারবি না কি তুই! তাও আবার বাড়ি থেকে এতোটা দূরে। অফিস করাটাই কি একমাত্র জরুরী ব্যাপার না কি জীবনে? কিছুদিন বাড়িতে থাক্‌। দৌড়োদৌড়ি করে শরীর স্বাস্থ্যও কালি হয়েছে। তারপর রাতুলের বাবা-মায়ের সঙ্গে কথাটা তুলব। ছেলেটাকে তো অল্প বয়েস থেকেই জানি। পড়াশোনায় তুখোড় অমন একটা ছেলে, কি করে যে অমনি একটা ভুল করে বসল। বিদেশে চাকরী করতে গিয়ে বিয়ে করে বসল কিনা মেম! খুব হয়েছে, বছর ঘুরতেই সে হাওয়া হয়ে গেলো। জানিসই তো, তোর বাবার বন্ধু মনোহরবাবু আর রুমা বৌদি বড় সাধাসিধে ভালো লোক, ছেলেটার ব্যাপারে খুব দাগা খেয়েছে। তোকে তো ছোট থেকেই খুব পছন্দ করে বৌদি?’। 
মা’র এসব কথা হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে সেদিনই বলে দিয়েছিল সূর্যতপা, সে কবে আবার বিয়ে করবে, আদৌ করবে কি না, কাকে করবে, এবার সেটা তার ওপরেই ছেড়ে দেওয়া হোক। কিন্তু আপাতত সে শান্তি চায় বেশ কিছুদিনের জন্য। একা থাকতে তার কোনই অসুবিধে হবেনা। পুরুষ বা নারীসঙ্গ কোনটারই একান্ত প্রয়োজন তার জীবনে এক্ষুনি নেই।   তপা’র এই মনোভাব দেখে মা বিরক্ত হলেও একজন তাতে সায় দিয়েছিল তপা’র হয়ে। সে হচ্ছে তপার দাদার বৌ। লিপি শিক্ষিত মেয়ে, একটি স্কুলের ইংরেজী শিক্ষিকা, তপা’র চেয়ে বছর খানেকের বড়। নিজের বিচারবুদ্ধি, মন, আর তপার জীবনে তার পারিপার্শিক অবস্থা দেখেশুনে সে তপা’র সাথে একমত হয়েছিল। শাশুড়িকে বুঝিয়েছিল, ‘থাক্‌ না মা ও ওর মত  করে কিছুদিন। অনেক তো ঝড় গেছে ওর ওপর দিয়ে, এখন কিছুদিন নিজের সঙ্গে নিজে দিন কাটাক স্বাধীনভাবে। আর তাছাড়া চিন্তা করবেন না। এখন দিল্লী, মুম্বাই, সব জায়গাতেই মেয়েরা এরকম একা থেকে চাকরী-বাকরি করে। আমাদের কলকাতাও পিছিয়ে থাকছেনা। তপা’র ফ্ল্যাটটা মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিঙে। দিন-রাত চব্বিশ ঘন্টার নিরাপত্তার দ্বায়িত্ব নিয়ে  দেখাশোনা করবার জন্য, ওসব জায়গায় সিক্যুরিটি মাসে মাসে পয়সা নেয়। 
কমলা সব শুনেটুনে চুপ করে গেলেও পরে গজগজ করেছিলেন। বলেছিলেন সূর্যতপা আর ওর বাবার কাছে একান্তে, ‘চালাক মেয়ে তো, এরকম করেই ননদ-কাঁটা সরাল, আর কিছুই না’।
‘আঃ , তুমি থামবে! এসব কথা আলোচনা করার এটা কি সময়? বউমা শুনতে পেলে কি মনে করবে?  তাছাড়া সৌর’ও তো বাড়ি ফিরল বলে, শুনলে ওরও কি খারাপ লাগবে না?’ বলে উঠলেন সূর্যতপার বাবা।  
সূর্যতপা’র একমাত্র দাদা সৌরনীল বাড়ির বিশেষ কোন ব্যাপারে সাতে-পাঁচে থাকেনা কোনদিনই। ডেলি-প্যাসেঞ্জারি করে অফিস সামলাতে সামলাতেই দিনের একটা বড় অংশ শেষ হয়ে যায় বেচারার। বোন তপা’র ডিভোর্সটায় একটু কষ্ট পেয়েছিল সে ঠিকই। একমাত্র বোনটার জীবনেই বা কেন এই ঘটনা ঘটল! শঙ্করকে তো সম্বন্ধ করে দেখেশুনেই পছন্দ করা হয়েছিল। দু-বাড়ির মধ্যে বেশ একটা মাখোমাখো ভাব তৈরি হতে শুরু করেছিল বিয়েটার পরে পরে। অথচ এমন একটা ব্যাপারে বৈষম্য তৈরি হবে কে জানত।
জানত বোধ হয় শুধু শঙ্কর নিজেই। মানুষটাকে বিয়ের পর ফুলশয্যার রাতে সূর্যতপার বেশ লেগেছিল। একটা মেয়েকে সিঁদুর পড়িয়ে ঘরে এনেছি বলে প্রথম সুযোগেই তার শরীরটার ওপর প্রভুত্ব ফলাতে হবে, এই ব্যাপারটা তার স্বামীর মধ্যে ছিলনা। সত্যিই তো, মানসিক কোন রকম সংযোগ স্থাপন ছাড়াই যারা শারীরিক মিলনের জন্য ব্যাগ্র হয়ে থাকে, সেই রকম জীবনসাথির সাথে কি কোনদিন কোন কেমিস্ট্রি তৈরি হয়! কিন্তু কেমিস্ট্রি’টা তৈরি হতেই  পারলনা। হনিমুনের পরেও যখন নানা অছিলায় বৌকে আদর-টাদর করতে অনীহা দেখাতো  শঙ্কর, তখন একমাত্র নিজের বৌদিকে এ কথাটা বলতে পেরেছিল সূর্যতপা। লিপি একটু ইয়ার্কি করে কথাটা ঘুরিয়ে দিয়েছে তখন। ‘তোর তো বাপু বরাবরই সেনসিটিভ ইন্টেলেকচুয়াল লাইফ-পার্টনার পছন্দ।  কিছুদিন যেতে দে, ভদ্রলোক আগে একটু অ্যাসেস করে নিক তোর  শরীরের কোন্‌ কোন্‌ পার্ট বিশেষ আকর্ষণীয়। তারপর দেখবি হামলে পড়বে নিজেই’।  
লাজুক হেসে সরে গিয়েছিল তপা। কিন্তু মাসখানেক পরে সেই বৌদিই ডেকে জিজ্ঞেস করল সূর্যতপাকে ব্যাপারটার সম্বন্ধে। তপা ততদিনে খানিকটা বেহায়ার মত বরকে কাছে টানারও চেষ্টা করতে শুরু করেছে। লোকে বলে তার চেহারা সাদামাটা হলেও একটা মিষ্টি লাবণ্য আছে।  পাঁচ-চার উচ্চতায় পঞ্চান্ন কিলোর শরীরটা নানা ভাবে বড় আয়নায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সে দেখে কোন তেমন খুঁত খুঁজে পায়নি। বরং নতুন স্যাটিনের গোলাপি নাইটিতে রাত্রিবাসের বেডরুমের নরম আলোয় বেশ মোহময়ী লাগতো তার নিজেকে। পরিস্ফুট স্তনবৃন্ত, সুডৌল নিতম্ব সবটাই তো উপেক্ষা করার মত নয়। সেদিন বহু প্রচেষ্টার পর শঙ্করের শরীর জেগে উঠেছিল ঠিকই, কিন্তু কি এক অমোঘ কারণে তার পুরুষাঙ্গ কিছুতেই সাড়া দিলনা। এইভাবে একরাত, দুই রাত, রাতের পর রাত কেটে যাওয়ার পর একদিন চেপে ধরেছিল সূর্যতপা তাকে। হ্যাঁ, শঙ্কর নিজের সম্বন্ধে এই ব্যাপারটা আগে থেকে জানত। কিন্তু  তার বন্ধুবান্ধবরা বলেছিল বিয়ের পর বউয়ের শরীরে হাত রাখলে আপনিই সব সমস্যা মিটে যেতে পারে। 
সব কথা লিপি জানবার পর শাশুড়ি আর নিজের স্বামীকে জানায়। সৌরনীল তো একেবারে আকাশ থেকে পড়েছিল। এমন সুন্দর খেলোয়ারের মতন চেহারা ছেলেটার। স্টেট লেভেলে ক্রিকেট-টিকেট ও তো খেলেছে বলেছিল। তবে কি সে সময়েরই কোন আঘাতজনিত এ দুর্ঘটনা! সম্পুর্ণ হতাশ হয়ে কান্নাকাটি করলেন খানিক কমলা। মেয়েটার কপালে এই ছিল কে জানত। ছেলে–ছেলের বৌ না হয় মাসের বড়ি খাওয়ার ব্যাবস্থা নিয়ে রেখেছে বছর খানেকের জন্য বাচ্চাকাচ্চা যাতে না হয় তার জন্য, কিন্তু মেয়েটার ঘরে নাতিপুতির মুখ তো তিনি কোনদিনই দেখে যেতে পারবেন না। রাগের মাথায় বেয়াইকে ফোন করে একদিন কিছু কড়া কথা বলে ফেলেছিলেন তিনি। 
পাশা’টা তখনই বদলে গেল। শঙ্কর ব্যাপারটা সম্পুর্ণ অস্বীকার করল। দোষ দিল সূর্যতপা’র ওপরে। কোন্‌ কোন্‌ প্রাক্তন প্রেমিক, বয়ফ্রেন্ডের সাথে এখনও সে বলে সম্পর্ক রেখে চলেছে। তাই স্বামীর ডাকে সাড়া দিতে বউয়ের অজস্র অনীহা। প্রায় প্রতিরাতেই শঙ্করকে নানা অজুহাত দেখিয়ে সে এড়িয়ে যায় শারিরীক মিলনের সমস্ত চেষ্টা। মাসে চার-দিন ছাড়া শরীর খারাপের অজুহাত টেকেনা, তাও হরদমই তার মাথাব্যাথা, জ্বর, পেটব্যাথা ইত্যাদি চলতে থাকে। বিরক্ত হয়ে পড়েছে শঙ্কর, ধৈর্যের বাঁধ আর কতদিন ধরে রাখা যায়, কতদিন বরদাস্ত করা যায় এ সব নখরা। বরদাস্ত করতে হোল না তাকে বেশীদিন। বিয়ের সাত মাসের মধ্যে বাপের বাড়ি চলে এসে, ডিভোর্স ফাইল করল সূর্যতপা। ভীষণ অবাক লেগেছিল যখন ডাহা মিথ্যে কথাগুলো শঙ্কর একের পর এক বলে চলেছিল দুই পরিবারের মিটিংএর দিনটায়। আলাদা হয়ে যাওয়ার পর, নিজের কাছে নিজেই বেশ কিছু প্রশ্ন রেখেছে সূর্যতপা। কোনটা বেশী হতাশ করেছে স্ত্রী হিসেবে তাকে, স্বামীর অক্ষমতা, না কি মিথ্যাবাদিতা। আচ্ছা, যদি বিয়ের পরপরই জানিয়ে দিত তাকে শঙ্কর এই গোপন রহস্যটার কথা, তাহলে কি হোত? তাকে কি ক্ষমা করতে পারত তপা? এমনিতে তো সে নিজেকে বেশ উদার মনোবৃত্তির মানুষ হিসেবে গণ্য করে। এমন  একটা ব্যাপার, যার জন্য মানুষটা দায়ী নয়, সেটা কি ক্ষমা করা যেত না? শরীর তার ক্ষুধা-তৃষ্ণা মেটাতে চায় প্রিয় মানুষের সংস্পর্শে এসে। কিন্তু সেটুকুই কি দাম্পত্য জীবনের মুলধন হিসেবে সব। একে অন্যেকে বুঝতে শেখা, ভালোমন্দ মিলিয়ে স্বীকার করে নেওয়া, তিলে তিলে পরম বিশ্বাসভাজন হয়ে ওঠা, দুঃখ-সুখের দিনগুলো হাতে হাত রেখে পেরোনো, এই সুদীর্ঘ যাত্রারই কি নাম সফল বিবাহিত জীবন নয়? হতাশা আসতই খানিকটা, তবু বড় কোন ডাক্তারের কাছে, দরকার হলে কলকাতার বাইরেও শঙ্করকে দেখাতে নিয়ে যেতে পারত সূর্যতপা। বিজ্ঞানের অগ্রগতি তো প্রতিদিনই হয়ে চলেছে। কিন্তু না, হার মেনে গেছে সে মানসিক ব্যাবধানটাকে সহ্য না করতে পেরে। একে অবিশ্বাস, তায় নিজের দোষস্খালনের চেষ্টায় স্ত্রী’র চরিত্রের প্রতি এতো কটু ইঙ্গিত, এ দুটো জিনিষ বড্ড নীচে নামিয়ে দিয়েছে শঙ্করকে সূর্যতপার নজরে। 
তপা তাও সামলে উঠেছিল তাড়াতাড়িই। আত্মীয় স্বজনের খোঁচাখুঁচি করে বিবাহবিচ্ছেদের কারণ জানতে চাওয়াটা অনেক অংশেই সে এড়িয়ে যেতে পেরেছে আলাদা ফ্ল্যাটবাড়িটায় উঠে যেতে পেরে। খুব ঘনিষ্ট সহকর্মী এক-দুজনকে ঘটনাটা জানালেও, অবাঙ্গালী বেসরকারী সংস্থায় এ সমস্ত ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় বা উৎসাহী লোক ভাগ্যিস কম। সূর্যতপা’র দিনগুলো তাই চাকরী করে, বই পড়ে, গান শুনে, সপ্তাহন্তে শপিং করে বা উলুবেড়িয়া ঘুরে এসে বেশ নিস্তরঙ্গ স্বস্তিতে কেটে যাচ্ছিল।
কিন্তু এই অশোকেন্দু মুখার্জি’র আইডেন্টিটিটা একবার দেখে নিতে হবে। লোকটা সাহিত্য-গানবাজনা বোঝে, তা তার পোস্ট দেখে আর কমেন্ট পড়ে খানিকটা বোঝা যায়। অথচ আজকাল ফেসবুকেও এমন সব ব্যাপার চালু হয়েছে যে সাবধান থাকতে হয়। এই তো সেদিন অফিসের রিদ্ধিমা বলছিল কি ভাবে একটি মেয়ে তার বন্ধু হয়ে যাওয়ার পর প্রায় প্রতিদিন রাত বাড়লে চ্যাটে ডাকতে শুরু করেছিল। কিছু কিছু কথাবার্তা একেবারেই পুরুষের অসংকোচ  অনুসন্ধিৎসু কথোপকথন যেন। তেমনটাই তো মনে হতে শুরু করেছিল রিদ্ধিমা’র। সন্দেহ হওয়াতে একদিন বসে মেয়েটির প্রোফাইল খুব ভালো করে স্টাডি করেছে সে। নানা রকম ইউ-টিউবের লিঙ্ক আর অন্যান্য লোকের পোস্ট শেয়ার করা ছাড়া মেয়েটির নিজস্ব কোন পোস্টই নেই। প্রোফাইল ছবিটি একটি টেডি বেয়ারের, হাতে গোলাপের গুচ্ছ ধরা। নিজের বরকে ব্যাপারটা বলাতে, সঞ্জয়ও ভালো করে ব্যাপারটা খতিয়ে দেখে। ‘যে ভাবে তোমার সাথে চ্যাট করার জন্য সময়টা বেছে নিয়েছে, যে ধরণের আলোচনায় সে আগ্রহী, তা দেখে আমি অন্তত বলতে পারি যে কোনও পুরুষের মানসিকতা নিয়েই কথা বলছে এই সো-কল্ড্‌ মেয়েটি। আই থিঙ্ক ইউ শুড কাম আউট অফ ইট’। 
সঞ্জয়ের এ কথাটা শুনে হঠাত মনে পড়েছে রিদ্ধিমার, সত্যিই তো, রিদ্ধি’র ফেভারিট ব্রেসিয়ারের ব্র্যান্ড, স্যানিটারি ন্যাপকিন না ট্যাম্পন পছন্দ, এ সব ব্যাপারে তার মেয়েবন্ধুরাও আলোচনা করার জন্য এতটা তো আগ্রহ দেখায় না! অতি সত্বর ব্লক করতে বাধ্য হয়েছে এই মেয়ে অথবা পুরুষ প্রোফাইল’টিকে রিদ্ধি।   
এই সমস্ত ব্যাপার মিলিয়ে মিশিয়েই সতর্ক করেছে সূর্যতপাকে। অশোকেন্দু মুখার্জি ভদ্রলোক  কিন্তু কলকাতারই অধিবাসী। সূর্যতপার চেয়ে প্রায় দশ বছরের বড়। মানে পঞ্চাশের কাছাকাছি তার বয়েস। পরিবারের কারও ছবি কেন তার প্রোফাইলে নেই জিজ্ঞেস করতে বিপত্নীক হওয়ার ব্যাপারটা বললেন অশোকেন্দু।  প্রায় বছর আটেক আগেই কোনও এক অ্যাক্সিডেন্টে  স্ত্রী ও বছর চোদ্দ-পনেরোর ছেলেকে হারান উনি। একটু লজ্জাই পেয়েছিল সেদিন চ্যাট করতে করতে সূর্যতপা। নিজের জীবনে একবার বিশ্বাসঘাতকতার মুখোমুখি হলে কি সব মানুষকেই সন্দেহর চোখে দেখতে হবে! অস্বস্তিতে পড়ল সে। আর কোনদিন এই ব্যাপারটা নিয়ে কোন প্রশ্ন সে করবেনা, নিজের কাছে নিজেই প্রতিজ্ঞা করল তপা।   
অসমবয়েসী বন্ধুত্ব বেশ এগিয়ে চলল। পথের পাঁচালিতে দুর্গার বয়েস কত ছিল অথবা  ফেলুদার গল্পের ইংরিজী ট্রান্সলেশন পড়ে ভাষার স্বাদ বা সুখ পাওয়া যায় কিনা, সবই আলোচনা চলত তাদের। মতানৈক্য যে হোতনা তাও নয়। সূর্যতপা একদিন ভারতীয় সঙ্গীতের  অসামান্য পরিধির কথা তুলতে বিঠোফেন, মোৎসার্ট নিয়ে খুব এক চোট আলোচনা করে ফেললেন অশোকেন্দু। নানা তুলনামুলক বাকবিতণ্ডায় প্রায় রাত দেড়টা বেজে গিয়েছিল সেদিন।  রেগেমেগে একটু রূঢ় ভাবেই বোধহয় কথাগুলো লিখে ফেলেছিল তপা, ‘পৃথিবীর সব বিষয়েই আপনার জ্ঞান সবচেয়ে বেশী, আপনার মতামতই চূড়ান্ত সত্য, এ কথাটা কথা আপনাকে বলল কে?’ শুভরাত্রি না বলেই বিদায় নিয়েছিল ওরা একজন অন্যজনের থেকে। 
দিন দুই পর সূর্যতপা আবিস্কার করল, শুধু রাতে ডিনারের পরে নয়, দিন’ভর বারবার নিজের মোবাইল থেকেও সে ফেসবুকের চ্যাটবক্স চেক করে চলেছে কোনও এক অচেনা কারণে। তিন দিন পর, আর না পেরে, ভদ্রলোককে ফেসবুকে আবার সক্রিয় দেখে, ‘হাই দেয়ার’ বলে ওপেনিং করে ফেলেছে তপা। অল্প বিরামের পর স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলতে শুরু করেছেন ভদ্রলোক। এবারে ক্ষমা চেয়ে নিলো চটপট সূর্যতপা। একে বয়েসে বেশ খানিকটা বড়, তায় দুঃখী একাকী মানুষ, এভাবে কথা বলাটা বোধহয় তার উচিত হয়নি। তাছাড়াও বিশ্বাসযোগ্য বন্ধু আজকাল পাওয়াই ভার, বিশেষ করে যার সঙ্গে মনের মত আলোচনা করা যায় তেমন মানুষ। আই-কিউ লেভেলের’ও একটা মিল থাকা দরকার। এ ছাড়া একা মেয়ের প্রোফাইল  দেখলেই অনেক পুরুষ হামলে পড়ে, উপযাচক হয়ে আলাপ করেই ন্যাকা-ন্যাকা কথা বলতে থাকে কিছুদিন পর থেকে। এ কারণে নিজের প্রোফাইল ছবিতে এখন বরের সাথে গলা জড়িয়ে ব্যাংকক বেড়াতে যাওয়ার একখানা ছবি লাগিয়ে ফেলেছে রিদ্ধিমা। কিন্তু এমন সব ব্যাপার একদম অপছন্দ সূর্যতপার। ফুল, সুর্যোদয়, বা সমুদ্র-সৈকতের ছবিওলা প্রোফাইল যেমন সে সযত্নে এড়িয়ে যায়, তেমনই এই স্বামীর পেছনে নিজেকে আড়াল করা স্ত্রীদের আত্মসন্মানবোধ সম্বন্ধে আশ্চর্য্য সন্দেহ জাগে তার মনে। যাই হোক এ নিয়ে রিদ্ধির সাথে আলোচনায় সে যেতে চায়নি। কিন্তু অশোকেন্দু’কে বন্ধুত্বের সঠিক ইকোয়েশনের থেকে হারাতে চায়না সে। মাপ  চাওয়ার পর কিন্তু প্রায় সঙ্গে  সঙ্গেই জবাব এলো, ‘মিটমাটের কম্পেন্সেশনটা দেবেন কি ভাবে?’। ‘চলুন, কোয়ালিটিতে কফি হয়ে যাক, টোটালি অন মি’, লিখে ফেলেছে উৎসাহের আতিশয্যে সূর্যতপা। বেশ খানিকক্ষণ নিশ্চুপ ওদিক। এই রে, আবার কিছু উল্টোপালটা তো লিখে ফেলেনি সে, ভাবল তপা।  
‘ফর সাম রিসন আই ডোন্ট হ্যাভ দা টাইম টু মিট ইউ, বাট আই হ্যাভ আনাদার রিকোয়েস্ট। অ্যাক্সেপ্ট মি টুডে অ্যাজ ইউর ফ্রেন্ড প্লিজ, তাছাড়া আজ থেকে আমরা ‘আপনি’ সম্বোধনটা বিসর্জন দিই।’ 
ওঃ হো, এই ব্যাপার, সত্যিই তো, চ্যাটেই এতো গল্প চলতে থাকে যে অশোকেন্দুর ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টটা যে কবে থেকে অপেক্ষা করছে তা খেয়ালই করতে পারেনি তপা। তবে বয়েসে অত বড় মানুষটাকে ‘তুমি’ সম্বোধন করতে একটু অসুবিধে হবে বইকি। রিকোয়েস্টটা ‘ইয়েস’ করে দেবে কিনা একটু ভাবতে না ভাবতেই বাংলায় টাইপ করা কয়েক লাইন এসে হাজির চ্যাটবক্সে, ‘পথপাশে পাখী পুচ্ছ নাচায়, বন্ধন তারে করিনা খাঁচায়, ডানা-মেলে-দেওয়া মুক্তিপ্রিয়ের কূজনে দুজনে তৃপ্ত, আমরা চকিত অভাবনীয়ের ক্বচিৎ কিরণে দীপ্ত’।   
‘মুখস্থ রেখেছ, নাকি সঞ্চয়িতা হাতে নিয়ে চ্যাট করতে বসেছ?’ লিখে ফেলল ইংরিজী স্ক্রিপ্টেই বাংলা কথাগুলো তপা।  
এবার অনুরোধ এলো ফোন নাম্বারটা দেওয়ার জন্য। রাত বেশী হয়নি সেদিন, পরদিন রবিবার। একটু আড্ডার মুডে তখন সূর্যতপা, দিয়েই ফেলল মোবাইল নম্বরটা। ফোনটা তাড়াতাড়ি এলো। আষাঢ়ের মেঘের মত গলার স্বরে পুরো কবিতাটা পাঠ করে শোনাল অশোকেন্দু। নিঃশব্দে শুনল সূর্যতপা। শেষ হওয়ার পর স্পিকারে রাখা মোবাইলটার সামনে হাততালি দিতেই ভারী গলাটা হাল্কা একটু রোম্যান্টিক মেজাজে ‘শুভরাত্রি’ বলে ফোন কেটে দিল। পরদিন চ্যাটে অশোকেন্দুর বরাতে ভূয়সী প্রশংসা জুটল আবৃত্তির জন্য।
রোববার বাড়ি যাবে তপা, আগের থেকেই বলে রাখল সে ফেসবুকের এই বন্ধুকে। ভুল বোঝাবুঝি বারবার হওয়া খুব অপছন্দ তার। বৌদি ব্যাপারটা শুনে মুচকি হেসে বলল, ‘ভালই তো, পুরুষ আর নারীর মধ্যে প্লেটোনিক সম্পর্ক তো বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে ইম্যাজিনই করা যায়না। লোকটা যে গায়ে পড়ে তোর বাড়ি খুঁজে এসে হাজির হতে চাইছেনা, যখন তখন চ্যাটে হাজিরা না দিতে পারলে তোকে পার্সোনাল প্রপার্টি ভেবে নিয়ে ঢঙের অভিমান শুরু করছে না, এটাই আশাবাদী ব্যাপার। বন্ধুত্ব জিন্দাবাদ, তবে হৃদয়ের সম্পর্কের ব্যাপারে দশবার হোঁচট খেয়ে বুঝে-শুনে এগোস তপা’। 
‘ধুর, ওসব ব্যাপারে লোকটার ইন্টারেস্ট থাকলে এতদিনে হাবভাব ধরে ফেলতাম না আমি? ব্যাপারটা ওদিকে যাবেই না। আমার চেয়ে বয়েসে বড় হলে কি হবে, মেঘে মেঘে বেলা তো আমারও হোল। তাছাড়া ঘরপোড়া গরু আমি বৌদি, সিঁদুরে মেঘ দেখলে তো সাঙ্ঘাতিক টেনশনেই দৌড়ে পালাই’। 
হা-হা করে হেসে ফেলল ওরা দুজনেই। তবু মনে মনে একটু খুশি হোল লিপি। তপা’র একাকীত্ব সে নিজে স্বীকার করেনা ঠিকই, কিন্তু নিজের সমবয়েসী মন আর শরীর দিয়ে তাকে বুঝতে কি আর পারেনা লিপি। একজন সঙ্গী তো দরকার বেঁচে থাকার জন্য, নইলে তো কুকুর পুষতে হবে এবার।  
ফোন-টোন কমই চলে, চ্যাটবক্সেই লেখার এতো কিছু থাকে যে ফোন করে কথা বলার প্রয়োজনটা কম মনে হয়। তাছাড়া ওরা দুজনেই লেখালেখি ভালোবাসে। ফেসবুকের গ্রুপ থেকে সরে এসেও নানান আলোচনা চালিয়ে যায় দুজনে মিলে চ্যাটের মাধ্যমে। মাঝেমধ্যেই  এটা-ওটা নিয়ে ধন্দ লাগলে টুক করে একটু গুগল্‌ সার্চও করে নেওয়া যায়। তবে দেখাসাক্ষাৎ করার সময় অশোকেন্দুর আর হয়ে ওঠেনা। 
এই সেদিন অফিস থেকে কিছু কলিগদের সঙ্গে শান্তিনিকেতন ঘুরে এলো সূর্যতপা। সেই ট্রিপের ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেছে সে। কিন্তু রোববারের আগে বাড়ি যেতে পারবেনা, তাই খুব ইচ্ছে করছিল তার কাউকে দেখায় ভুবনডাঙ্গার মাঠ থেকে কিনে আনা জিনিসগুলো, কাঁথাকাজ করা ঝোলা ব্যাগ, লিপস্টিক রাখার জন্য চামড়ার ছোট্ট বাক্স, আর ডোকরার সাঁওতাল দম্পতির ছোট্ট সুন্দর মুর্তিটা। এসব দেখানোর জন্য স্কাইপের কথাটা তুলতে জানা গেল অশোকেন্দুর সে কানেকশনই নেই। কিভাবে নিজের বিজনেস চালায় সে জিজ্ঞেস করতে জবাব এলো, অশোকেন্দুর ক্লায়েন্টদের সাথে বিশেষ ডিল করতেই হয়না। বিশ্বাসী ম্যানেজার তার এ সব কাজই সামলে নেয়। আবার নানা প্রশ্ন করতে গিয়েও নিজেকে সংযত করল তপা। অনধিকার চর্চা করে পুরনো ক্ষতস্থান রগড়ে রুধিরাক্ত করবে না অশোকেন্দুকে সে কোনমতেই, নিজেকে নিজেই মনে করাল সে। কই,  ডিভোর্সি জানার পর থেকে, সে মানুষটা তো সূর্যতপা’র জীবনের সবচেয়ে যন্ত্রণার রহস্য জানার জন্য প্রশ্ন করে করে কখনও উত্যক্ত করেনি তাকে। বরং, তপার জীবনের পরবর্তী অধ্যায়ের প্ল্যানিং কি, কেন, কোনো কিছুই জানতে চাওয়ার তেমন উৎসাহ নেই অশোকেন্দুর। সে যেন অতীত পেড়িয়ে এসে একমাত্র বর্তমানেই থিতু হয়ে থাকতে চায়। অবশ্য তাতে সূর্যতপা’রও আপত্তি বিশেষ নেই। এই নির্ভার নিশ্চিন্ত সম্পর্ক তারও ভালো লাগে। তার ভালো লাগে মার্জিত মানুষটাকে। অশোকেন্দুও তাকে খুবই পছন্দ করে, সে বুঝতে পারে। আজকাল তার শরীর ভালো না থাকলে, অথবা অফিসে বসের সাথে অল্পস্বল্প মনোমালিন্য হলে, তার লেখার ঢঙেই বুঝে যায় অশোকেন্দু। তেমনি খুব বেশী আনমনা হয়ে থাকলে অশোকেন্দু’কে তপা কখনও ডিনারের পর লিখে পাঠায়, ‘টেন্ডার ইস দা নাইট, অ্যান্ড হ্যাপলি দা কুইন মুন ইস অন হার থ্রোন’। রাতের জ্যোৎস্নার ভেতর থেকে জবাব আসে, ‘জানো সূর্যতপা, ‘টেন্ডার ইস দ নাইট’ একটি বিখ্যাত নভেলের নামও বটে। স্কট ফিটজেরাল্ড লিখেছিলেন এই কাহিনী এক রোগিণীর সাথে এক মনস্তত্তবিদের সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে। গল্পে মহিলা পরে তার স্ত্রী হয়েছিলেন’। ভালো লাগে এরকম কথা জানতে, কিছু জানাতে, আলোচনা করতে। অথচ প্রয়োজনীয় ব্যাবধান দুটি মানুষ অতিক্রম করেনা।
তপা’কে কিন্তু কখনই ছোট নামটা ধরে ডাকেনা অশোকেন্দু। ‘তোমার পুরো নামটাই যে ফ্যান্টাস্টিক সূর্যতপা, ইউ ও্যরশিপ দ সান গড, আমি তো তা পারিনা। আমার অধিকার কি তাহলে এমন শক্তিতে ভরপুর সুন্দর নামখানাকে ছেঁটে-কেটে খেলো করার!’  
কথাগুলো একটু ধোঁয়াশা ঠেকলেও বেশ লাগলো কানে সূর্যতপার। ‘তুমিও তো তোমার নামে চাঁদ-ফুল-জ্যোছনায় মাখামাখি হয়ে রয়েছ’, অশোকেন্দু’কে বলে তপা। 
‘এখন না তো চাঁদ দেখি, না কোনও ফুল, এক সূর্যতপস্বিনী’র মনের খবরাখবর নিয়েই দিন কাটে আমার, জানোনা!’ একটু হেঁয়ালি মিশিয়ে ঠাট্টা করে অশোকেন্দু। 
‘ও হো, তাই নাকি মশাই’, হেসে ওঠে তপা’ও। 

দিন কেটে যায় তার নিজস্ব হিসেবে। সম্পর্কটা বিশেষ কোথাও এগোয় না। এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনও বোধহয় মনে করেনা সম্পর্কের ভাগীদাররা। কিছুদিন আগে অশোকেন্দু’র প্রোফাইল ছবিটা বদলাতে বলেছে সূর্যতপা। সেই কবেকার বোধহয় দশ-বারো বছরের পুরনো  ছবি। কোনো হিল স্টেশনে বেড়াতে গিয়ে বোধহয় তোলা। দূরের পাহাড় দেখতে দেখতে কেউ বোধহয় পেছন থেকে ডেকেছিল অশোকেন্দু’কে। অল্প মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়েছে সে। এক মাথা  চুল হাওয়ায় এলোমেলো, একজোড়া বুদ্ধিদীপ্ত চোখ জ্বলজ্বল করছে, আর অল্প একটু হাসির  আভাস ঠোঁটের কোণে। ডান হাতের সিগারেটটা মুখে স্পর্শ করাবে কি না ভেবে উঠতে পারছেনা সে। 
‘ওরকম উত্তম-মার্কা ছবি তুলতে গিয়েছিলে কেন শুনি?’ লিখে পাঠাল একদিন তপা। 
‘মনে মনে বলছিলাম, “অর্ঘ্য থালা কৃষ্ণপক্ষ রাতে, যে আমারে দেখিবারে পায়, অসীম ক্ষমায়, ভালোমন্দ মিলায়ে সকলি, এবার পূজায় তারে আপনারে দিতে চাই বলি” ’। 
‘বাঃ, পাহাড়টা কি শিলং পাহাড় ছিল’ প্রশ্ন পাঠাল তপা’র কি-বোর্ডের অক্ষরগুলো। 
‘না না, যতদূর মনে পরছে ঘাটশিলার ফুলডুংরি পাহাড় ছিল ওটা। তবে এই কবিতা আবৃত্তির রোগটা তো আমার বহুদিনের, এরকম সব জায়গায় পৌঁছলে সেটা রে-রে করে তেড়ে আসে’। 
অশোকেন্দু’র কথার ভাবসাবে আপনমনেই হেসে ফেলল সূর্যতপা আবার টাইপ করতে করতে,  ‘বেশ তো, নাহয় এরকম একটা সুন্দর কবিতা পাঠ করে আমায় গিফট করে পাঠালে তুমি, আসছে শুক্রবার আমার জন্মদিন, জানতো? ফোনে অডিও মেসেজ চাই কিন্তু আমি’। 
জবাব এসে গেলো, ‘হ্যাঁ, দেখেছি মুখবইতে তোমার জন্মের তারিখটা। আমার শরীরটা কিছুদিন ভালো যাচ্ছেনা, কাজের চাপও পড়েছে। এ সময়ের ভাইরাল জ্বরজারি আর কি। তবুও তোমার উপহার আমি পাঠাবো’। 
‘টেক কেয়ার, সাবধানে থেকো’ এই লিখে সেদিনের কথা শেষ হোল। 

কদিনের ছুটি নিয়ে বাবা-মা, দাদা-বৌদির সঙ্গে মুকুটমণিপুর ঘুরে এলো সূর্যতপা। খুব ভালো লাগলো অনেকদিন পর আবার খোলা হাওয়ায় শ্বাস ফেলতে, গলা ছেড়ে গান গাইতে। ইন্টারনেটের কাজকর্ম ইচ্ছে করেই সঙ্গে নিয়ে যায়নি তপা। কাজ ভুলে অকাজে মত্ত থাকবে তাই জন্যই তো যাওয়া। দিন সাতেকের ট্রিপ শেষ করে ফিরে এসেই ঘাড়ে পড়ল অনেক কাজ। অফিসের কাজ শুধু নয়, নিজের ফ্ল্যাটটা যতই ছোট হোক না কেন বাসযোগ্য করে তুলতেও তো সময়, পরিশ্রম দুটোই দিতে হয়। বেড়ানোর জায়গাটাতে সবাই মিলে জন্মদিন  পালন ভালোই কেটেছে। কিন্তু, এই রে, একজন যে ভয়েস মেসেজে আবৃত্তি পাঠিয়ে রেখেছে তা তো শোনাও  হয়নি, না ধন্যবাদ দেওয়া হয়েছে। স্নান-টান সেরেই মোবাইল খুলে কবিতাটা শুনে ফেলল তপা। ঈষৎ ভারী গলার আওয়াজে পুরুষালি ব্যারিটোনের স্নিগ্ধ মাধুর্য। অসাধারণ সুন্দর আবৃত্তি’খানা। প্রায় পুরো কবিতাটাই পাঠ করে পাঠিয়েছে অশোকেন্দু। একটু খবর  নেওয়া যাক মানুষটার। ধন্যবাদও জানাবে সে। আর শোনাবে বেড়ানোর সব গল্প। আজকের দিনটা ছুটি নিয়েছে তপা, কাল থেকে আবার  অফিসের চাপ। ল্যাপটপ’টা টেনে নিয়ে তপা বুকের তলায় বালিশ গুঁজে ফেসবুকে টাইপ করল অশোকেন্দু মুখার্জি। একবার নয়, বেশ কয়েকবার। কিন্তু কালো, টেকো, হাসিমুখ, গোমড়া অজস্র অশোকেন্দু পর্দায় এসে হাজির হলেও ঘাড় ফিরিয়ে মুচকি হাসির মানুষটাকে দেখা যাচ্ছেনা তো! রাগ হোল একটু, তাকে কি ব্লক করল অশোকেন্দু! কোন দোষে? অথচ বেড়াতে যাওয়ার আগের চ্যাটের কথাবার্তাগুলো বেশ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। চ্যাটবক্সে তারপর অবশ্য এক লাইনও আর লেখেনি অশোকেন্দু। তপা ফ্যামিলির সাথে বেড়াতে যাচ্ছে।  পারফেক্ট জেন্টলম্যান এই সময়ে নাক গলিয়ে বিরক্ত করেনা। কিন্তু মুখবইয়ের অশোকেন্দু মুখের্জি গেলো কই! একটু অবাক হয়ে মোবাইলে নম্বরটা খুঁজে ফোন করল তপা। ‘নম্বরটি অস্থায়ী রূপে কাজ করছেনা’ শুনতে শুনতে মাথা ব্যাথা হয়ে গেলো তার। অভিমান হোল, রাগ হোল, বিরক্তি এলো, তারপর এলো চিন্তা। যাওয়ার আগে শরীরটা খুব একটা ভালো ছিলনা অশোকেন্দু’র, শুনে গিয়েছিল সে। কিন্তু এখন সে ভদ্রলোকের খবর নেবে কি করে! একটা মানুষের অস্তিত্ব শুধুমাত্র কম্পুটার স্ক্রীনে আর ফোনের গলার স্বরেই রয়েছিল এতদিন, সে ব্যাপারটা বোধগম্যই হয়নি এতদিন সূর্যতপা’র।  
তবে খবর এলো একটা। শনিবার দুপুরেই ফোনটা এলো তার কাছে। অশোকেন্দু মুখার্জির বাড়ির কেয়ারটেকার ভদ্রলোক বাড়ির ঠিকানাটা দিলেন। অশোকেন্দু অসুস্থ, তাকে একবার দেখতে যেতে সে অনুরোধ করেছে। এবার পথে এসো, মশাই এতদিনে তো কখনও দেখা  সাক্ষাৎ করার জন্য কোন উৎসাহই দেখাও নি। এখন ভাইরাল ফিভারে কুপোকাত হয়েই এই অবস্থা, গিয়ে দেখা করে মানসিক জোর বাড়িয়ে তার সুস্থতাকে ফেরাতে হবে, এই আবদার। সত্যি, মানুষ যে কখন কি চায় তা সে নিজেও জানেনা।  
লাউডন স্ট্রীটটা খুব একটা দূরে নয়। বাড়ির নম্বর মিলিয়ে ঠিক জায়গায় এসে ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিল সূর্যতপা। বেশ পুরনো দিনের বাড়ি। দোতলার ঘর সবগুলো ব্যাবহার হয় বলে মনে হয়না। বাইরের স্নোসেম বেশ কিছু বছর করানো হয়নি। গাড়িবারান্দার তলায় অ্যাম্বাসাডর যেটা দাঁড়িয়ে তারও যত্নআত্তি মনে হয়না যে করা হয়। লোকটা তো পঞ্চাশের কোঠায় বয়েস বলেছিল, তাহলে এমন প্রাচীন যুগে বসবাস কেন! একটু অবাক হয়েই দরজার বেল টিপল তপা। বেশ খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হোল। ব্যাগে করে সে ডার্ক চকোলেট এনেছে। তাদের দুজনেরই পছন্দের জিনিস। গল্প করতে করতে খাওয়া যাবে বেশ। প্রথম বার দেখাশোনায় আর কি উপহার নিয়ে আসা যায়, ভেবেই পায় নি সূর্যতপা। আজ ভালো করে অশোকেন্দু’র বই আর গানের অ্যালবামের স্টক দেখবে সে। মোবাইলে তোলা মুকুটমনিপুরের কিছু ছবি দেখাবে তপা চা খেতে খেতে। আর দেখবে অশোকেন্দু’র কম্পিউটারটা, সেই যন্ত্র যা তাদের দুজনের মধ্যে সেতুবন্ধন সৃষ্টি করেছে। নিশ্চয়ই বড়সর ডেস্কটপ ব্যাবহার করে ভদ্রলোক। ছবিতে মানুষটার গায়ের রঙ বেশ ফরসা মনে হয়, লম্বা কতটা তা অবশ্য বোঝার উপায় নেই। তপা নিজে আজ একটা হলুদ শাড়ি পড়ে এসেছে। সুর্যের মত হলুদ রঙ শাড়িটার। বন্ধুরা বলে শ্যামলী সূর্যতপাকে হলুদে কিন্তু দারুণ ব্রাইট দেখায়। শোনা যাবে অশোকেন্দু কি বলে। 
এতো কিছু ভাবতে ভাবতে ভেতরে পায়ের শব্দ এগিয়ে আসছে শুনতে পাওয়া গেল। পাজামা আর গেঞ্জী পড়া একজন আধবুড়ো মানুষ দরজা খুলেই কি করে যেন তপা’কে চিনে  ফেললেন। 
‘আসুন তপা দিদিমণি, সাহেবের সঙ্গে আপনার দেখা করাটা বড় জরুরী। একা একাই থেকেছে এতগুলো বছর, কিন্তু এ সময়ে একজন কেউ আপন এসে না দাঁড়ালেই নয়। আসুন, ওপরের ঘরে নিয়ে যাই আপনাকে আমি’। 
ব্যাপারটা ঠিক কি ঘটেছে তা বোঝার চেষ্টা করতে করতে সিঁড়ি চড়ে দোতলার প্রথম তালা না লাগানো ঘরটায় ঢুকল সূর্যতপা। পুরনো দিনের খাড়া সিঁড়িগুলো ভাঙতে একটু কষ্টই হয়েছে তার। যাই হোক, আধভেজানো দরজাটা খুলে একটা বেশ বড় ঘরের মধ্যেখানে এসে হাজির হোল সে।  একদিকে একটা মিউজিক সিস্টেম ছাড়াও তেপায়া টেবিলের ওপর মান্ধাতা আমলের একটা গ্রামোফোন রাখা রয়েছে দেখা যাচ্ছে। অন্য দেয়ালটা জুড়ে, মাটি থেকে বেশ অনেকটা ওপর অব্দি বইয়ের আলমারি। সব কিছুই এতো পুরনো আর ধুলোর পাতলা সর দিয়ে ঢাকা, যে সূর্যতপার এক-আধবার মনে হচ্ছিল যে কোমরে কাপড় গুঁজে পরিস্কার করতে লেগে যায়। দেওয়ালে যে মানুষটা একমুখ ঝকঝকে হাসি নিয়ে ছবিতে ব্লো –আপ হয়ে রয়েছে, তারই তো আধখানা মুখচ্ছবি ঘাড় ফেরানো অবস্থায় ফেসবুকে দেখেছে তপা। সুদর্শন মানুষ, এখনও হয়ত তেমনটাই রয়েছে। কিন্তু লোকটা কোথায়! বিরাট ঘরটার এক দিকে বড় একটা পুরনো দিনের খাটের দিকে এগিয়ে চলল গেঞ্জি-পাজামা পরা পথ-প্রদর্শক। 
‘সাহেব বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে দিদিমণি, ভালো নেই তো খুব একটা’। 
কখন লোকটা ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছে টের পায়নি সূর্যতপা। কিন্তু এ কে শুয়ে রয়েছে এখানে চোখ বুঁজে। চোখ বলতে শুধু একটাই চোখ দেখা যায়, অন্য অক্ষিকোটরটা প্রায় শুকিয়ে ভেতরে ঢুকে গিয়েছে। প্রায় সারা মুখটাই বীভৎস ভাবে পোড়া। কোঁচকানো গালের চামড়ায় অসংখ্য ভাঁজ বটের ঝুরির মত। ভুরু বা মাথার চুল কোনটাই নেই। দুহাত বুকের ওপর রাখা, তাতেও অজস্র যায়গায় পুড়ে ঝলসে যাওয়ার যন্ত্রণার ইতিহাস। কোমর থেকে পা অব্দি যেভাবে ঢাকা, মনে হয়না এ মানুষ খুব একটা চলাফেরা  করতে পারে। কাছের টেবিলে ল্যাপটপ,  চশমা, এছাড়া কিছু বই । টেনিসন, শেলি, আর ‘শেষের কবিতা’। একটা দমচাপা গন্ধ  চারদিকে, একটাও জানলা খোলা নেই। খাটের ছত্রির একপাশে ঝুলন্ত মাকড়সার ঝুলটা মুখ ভ্যাংচাচ্ছে নাকি সূর্যতপা’কে! নিঃস্তব্ধ মানুষটার কদর্য মুখটা দেখতে দেখতে গলার কাছে কি যেন দলা পাকিয়ে উঠছে ক্রমশ তপার। ঢিমে বিকেলের আলোয় লোকটা ঢোঁক গিলতে চেষ্টা করছে, দেখতে পেল সে। সরু উঁচু কণ্ঠার হাড়টা কি বীভৎস ভাবে ওঠা-নামা করছে। যেন   প্রচণ্ড কষ্টে  খানিকটা লালা গিলতে পারল মানুষটা, বাকিটা কশ গড়িয়ে পড়ল বালিশে, আর হাপরের মত ওঠা-পরা করতে লাগল পাতলা আধময়লা ফতুয়ার নীচে কঙ্কালসার বুক-পেট। আর দাঁড়াতে পারল না সূর্যতপা। এ কোন অশোকেন্দু! এমনটা তো তাকে কল্পনা করে উঠতে পারেনি কোনও দুঃস্বপ্নেও সে। মুখ ঘুরিয়ে মুখে আঁচল গুঁজে হুড়মুড় করে পেছন ফিরে দৌড়ল তপা। কিভাবে কখন যে সে অতগুলো উঁচু সিঁড়ি ভেঙ্গে নেমে এসেছে, তার নিজেরও খেয়াল নেই। একটা প্রচন্ড গা-গুলোনো ভাব নিয়ে দৌড়োতে দৌড়োতে বড় রাস্তায় পৌঁছে একটা ট্যাক্সি পেয়ে উঠে পড়ল সে। লজ্জা ভুলে হাউহাউ কান্নায় ট্যাক্সিওলাকে অবাক করে ফেলল তপা।  যতক্ষণে সে বাড়িতে পৌঁছেছে ততক্ষণে কয়েকটা মিসড কল বোধহয় মোবাইলটায় আসছিল। ফ্ল্যাটে ঢুকে দরজা বন্ধ করে কাঁধের ব্যাগ ছুঁড়ে ফেলে প্রথমেই বাথরুমে পৌঁছেছে তপা। তারপর শাড়ি-ব্লাউজ সব শুদ্ধু শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে আর একবার অবাক অসহায় কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।  
কোনও খবর আর আসেনি দিন-দুয়েক। তিন দিনের দিন এক অ্যাডভোকেট ভদ্রলোক ফোন করে দেখা করতে চাইলেন তপার সঙ্গে। এলোমেলো লোকের সাথে দেখা করতে বেশ অনেকবার মানা করে দিয়েছে বৌদি। কিন্তু এ লোকটা অশোকেন্দু’র নাম নিলো। ফ্ল্যাটে নয়, অফিসের কাছে কফিশপে দেখা করল তপা। অশোকেন্দু মুখার্জি আন-কনট্রোলড হাই ব্লাডপ্রেসারে আক্রান্ত ছিলেন বেশ কিছুদিন। দুটি কিডনিরই ফেলিওরে ভুগছিলেন কিছু মাস।  শেষ দিকে ডায়ালিসিসও আর কাজ দেয়নি। শরীরে ইউরিয়া ক্রিয়াটিনিন জমতে জমতে চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল। প্রায় কোমায় পড়েছিলেন শেষ ক’দিন তিনি।  
নিজস্ব কাপড়ের ফ্যান্সি ম্যাটেরিয়ালের ফ্যাক্টরি ছিল ওনার। একসময়ে অনেক এক্সপোর্ট সাপ্লাই এর কাজও পেতেন। আসানসোলে কাছাকাছি ওনার ফ্যাক্টরিটা ছিল। ফ্যাক্টরির কাছাকাছি বাড়ি থাকাতে আসা যাওয়ার ঝক্কি কম ছিল বেশ। কিভাবে কি করে কার শত্রুতায় সে রাতে আগুন  লেগেছিল কারখানায় বুঝতে পারেন নি অশোকেন্দু। ফোন পেয়ে নাইট-সুট পরেই ঘুমন্ত স্ত্রী  আর বছর পনেরোর ছেলেকে বাড়িতে রেখে বাইরে থেকে দরজা টেনে দিয়ে গাড়ি নিয়ে দৌড়েছিলেন তিনি কর্মস্থলে।  কর্মচারীদের প্রচেষ্টা সত্তেও অনেকটা লোকসান হয়ে গিয়েছিল। দমকলের লোকেরা এসে আগুন নেবাতে ব্যাস্ত হয়ে পরেছিল। সেখানেই ঘন্টার পর ঘন্টা কেটেছে অশোকেন্দুর সে রাতে। বেশী রাতে এক সময়ে ফ্যাক্টরি থেকে বাইরে বেরিয়ে  নিজের কোয়ার্টারের দিকে তাকিয়ে ভীষণ চমকে উঠেছেন তিনি। আগুনের লেলিহান শিখা কখন ওদিকেও পৌঁছে গেছে টের পাওয়া যায়নি এখানকার গোলমালে। সে রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় উঠে পড়লেও আটকে যাওয়া মেন দরজার কাছাকাছি পৌঁছে উঠতে পারেনি তার স্ত্রী আর পুত্র। পাগলের মতন বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে সবার হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে ভেতরে ঢুকতে গিয়েছিলেন অশোকেন্দু। বাঁচাতে পারেন নি ওদের। আগুন দয়া করেনি অশোকেন্দুকেও। বিশ্রী ভাবে প্রায় ষাট শতাংশ পোড়া শরীর নিয়ে বহুদিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল তাকে।

কাগজপত্র দেখিয়ে জানালেন ভদ্রলোক যে, মৃত্যুর পর অশোকেন্দু বসতবাড়িটা একটি অনাথাআলয় বানানোর জন্য দান করে গিয়েছেন। কাগজে কলমে অনুরোধ জানিয়ে গিয়েছেন সূর্যতপা’কেই সেই জায়গাটির দেখাশোনা করবার জন্য। আর রেখে গেছেন নিজের কিছু ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স তার নামে। কি বলবে বুঝতে পারছিলনা সূর্যতপা। খানিকটা যন্ত্রের মত ঘাড় নাড়িয়ে সন্মতি দিয়ে দিলো ব্যাপারটায়। কিছু ভাবার মত ক্ষমতা যেন লোপ পেয়েছে মন থেকে তার গত ক’দিন  ধরে। আশাহত, না আশাভঙ্গ, কোনটা তাকে এমন একটা অবস্থায় এনে ফেলছে মানসিকভাবে তা সে নিজেই বুঝে উঠতে পারছেনা। অথচ অশোকেন্দুর দোষ কি সত্যিই দেওয়া যায়? সে তো কোনও মিথ্যে পরিবেশন করেনি সূর্যতপা’র সামনে। গত ক’মাসের দিন  আর রাতগুলো রঙিন আলোতে সাজিয়ে দেখতে শুরু করেছিল বোধহয় তপা’ই। আর অশোকেন্দু, সে জীবনের শেষ সায়াহ্নে পৌঁছে যাচ্ছিল খুব দ্রুত আর নিশ্চিত ভাবে, তা জানত সে। কোনরকম ছলনা নয়, শুধু আগত মৃত্যুর চিন্তাটা আর একাকীত্বকে দূরে রাখার চেষ্টা করতে করতে পেয়েছিল একজন মনের মত মানুষের সন্ধান, যদিও বড্ড বেশী দেরী হয়ে গেছে তখন। 
পরদিন রবিবার, তাও তপা বাপের বাড়ি গেলনা। অছিলা করল অফিসের কাজের চাপের। সারাটা দিন ধরে পুরনো চ্যাটবক্সের কথোপকথন পড়তে পড়তে হঠাতই মনে পড়ল অশোকেন্দুর পাঠানো জন্মদিনের প্রথম আর শেষ উপহারের কথা। মোবাইলে অডিও-ক্লিপ’টা  চালিয়ে চোখ বুজে নিজের প্রিয় ইজীচেয়ারটায় গিয়ে বসল সে। গমগমে ভারী গলায় সুমধুর স্বরের মাধুর্য বলে উঠল শেষ কয় পঙ্কতি, ‘হে বন্ধু, তুমি নিরুপম, হে ঐশ্বর্যবান, তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারই দান। গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়, হে বন্ধু বিদায়’। 

No comments:

Post a Comment

Facebook Comments