html

Saturday, April 28, 2018

শিবানী শর্মা

সারপ্রাইজ

শিবানী শর্মা


সুচিত্রা বোর্ডিং পাস নিয়ে, লাউঞ্জে বসতেই সামনের ডিসপ্লে বোর্ডে দেখল, দিল্লীর ফ্লাইট দু ঘণ্টা দেরীতে।  সঙ্গে সঙ্গে একটা বিরক্তি ঘাড় বেয়ে উঠলো। দু ঘণ্টা সময় কাটানো বড্ড বোরিং আর তাছাড়া আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরা খুব জরুরী। আজ তার বুচানের জন্মদিন। হোটেল, কনফারেন্স, ডিনার, গত কাল সারাদিনে একদম সময় পায়নি, তবুও তার মধ্যে বুচানের জন্য একটা গিফট কিনতে পেরেছে... একটা বেশ দামী আই-ফোন।  এখন মাত্র এগারোটা বাজে, একটার সময় টেক অফ করলেও, চারটে অবধি বাড়ি ফেরা যেতে পারে । সুচিত্রা এবার উঠে গিয়ে কফি কিনে আনল। হাতে বিশেষ কোন লাগেজ নেই, তাই ঘোরা ফেরা সুবিধে। স্বামী মারা যাবার পর, সুচিত্রা নীচের তলায় থাকে, একলা নিজের মতন। ওপরের তলায় ছেলে বউ আর তার নাতি । উপরের আলাদা সিঁড়ি, ওরা ওঠা নামা করে, থাকে নিজের মতো ।কথাবার্তা কমই হয়। সুচিত্রা অর্থনীতির প্রফেসর, এখন বয়স হয়েছে, সপ্তাহে শুধু দুদিন ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়। কিছুটা সময়টা বই লেখা, মাঝে মাঝে এই রকম এক আধটা কনফারেন্স আর বাকী সময়টা কাটে বুচান কে নিয়ে। বুচানই এখন তার সবচেয়ে বড় বন্ধু। এবার দশ বছরের হল বুচান। আজকালকার বাচ্চা, ভীষণ সপ্রতিভ, ওদের খুশি করা ভীষণ কঠিন, তাই এই দামী গিফট । আজ, ওকে একটা বড় সারপ্রাইজ দেবে, ওর ঠাম্মা।

দিল্লীতে নেমে, লাগেজ নিয়ে, ট্যাক্সি ধরতে ধরতে সাড়ে তিনটে । ট্যাক্সি নিয়ে এবার কনটপ্লেস, বুচানের সবচেয়ে প্রিয় চকোলেট কেক, অর্ডার ছিল না তাই নাম লিখিয়ে প্যাক করিয়ে আরও আধ ঘণ্টা। বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় পাঁচটা । বাড়িতে ঢুকে, জিনিসপত্র রেখে ইন্টার-কম ডায়াল করল, উপরে রিং হচ্ছে, কেউ তুলছে না।

সুচিত্রা এবার নিজের মোবাইল ফোন বার করলো, দেখে সেটা বন্ধ। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়লো গত কাল সকালে কনফারেন্স হলে সে এটা বন্ধ করেছিল, তার পর আর অন করা হয়নি, কারণ এরপর আর দরকারই হয়নি, আর মনেই নেই ।  দু মিনিট পরে ছেলে তীর্থ কে ফোন করল সুচিত্রা, অনেকক্ষণ রিং যাবার পর, তীর্থ ফোন তুলল, একেবারে যেন ফেটে পড়ল, ‘তুমি কোথায় মা, কাল থেকে তোমাকে ফোন করছি, তোমার ফোন বন্ধ। তোমার হোটেল ও জানা ছিল না, নইলে ওখানে মেসেজ ছাড়তাম কিছুই তো জানাতে চাও না তুমি আমাদের। আমরা তো জিম করবেট এসেছি বুচান কে নিয়ে, পরশু ফিরবো । 

সুচিত্রা একটু থমকে গেলো, ‘তোদের এই প্ল্যান আমাকে জানাস নি তো’।  তীর্থ বলল, মা এটা বুচানের জন্য একটা সারপ্রাইজ ছিল। তাই গতকাল রাত্রেই ওকে জানানো হয়েছে। এই নাও তুমি বুচানের সাথে কথা বল । 

এবার অপর প্রান্তে এবার বুচান , ‘হাই ঠাম্মা, তুমি কোথায়, মিসিং ইউ সো মাচ’
সুচিত্রার হটাতই কেমন যেন কান্না পেয়ে গেলো, তবুও শক্ত হয়ে বলল, ‘হ্যাপি বার্থ ডে বুচান, তুমি এনজয় কর, আচ্ছা বাই’। 

সুচিত্রা মুখ হাত না ধুয়ে, সেই কাপড়েই, অনেকক্ষণ বসে রইল, চুপচাপ । খুব একা, নিঃস্ব, অসহায় লাগছিলো নিজেকে। নিজের ছেলের জন্য, নাতির জন্য খুব মন খারাপ হচ্ছিল। ছটা নাগাদ এক কাপ চা খেয়ে, কাপড় বদলে, সুচিত্রা এবার বাড়ির বাইরে । 

এই পাড়ার ঠিক পিছন দিকেই একটা বস্তি, লাগোয়া ছোট্ট পার্ক । তার একটা বেঞ্চে বসে, এখন এক অদ্ভুত, অলীক, অবর্ণনীয় সুখে ডুবে আছে, সুচিত্রা।  পনেরো কুড়িটা নানা বয়সের বাচ্চা, ওকে ঘিরে হইচই করছে, নাচছে, হাততালি দিচ্ছে, ছুটোছুটি করছে, ওদের হাত, মুখ চকোলেট কেকে মাখামাখি।


-------------------------------------------------------

দাগ 




দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজে বাসন্তীর ঘুম ভাঙল। রাখাল বাড়ি ফিরেছে। শীতের সকাল, সাতটা বাজে অথচ বাইরেটা এখনও ঝাপসা, অন্ধকার, কুয়াশাচ্ছন্ন । দরজা খুলে দিয়ে বাসন্তী আবার লেপের ভিতর ঢুকে পড়লো। কয়েকদিন ধরে বড় ধকল যাচ্ছে , বাসন্তীর মা প্রমোদাবালা হাসপাতালে, পালা করে সবাই ডিউটি দিচ্ছে। দিনে কখনও সে, কখনও মেজদি । রাতে বেশীর ভাগ রাখালই থাকছে। আশীর কাছাকাছি বয়েস প্রমোদার, জলে ভরে গেছে শরীরটা, ফুলে গেছে, গতকাল থেকে খুব ভাসা ভাসা, আবছা জ্ঞান ।

আজ মেজদির পালা, বাসন্তী লেপের উষ্ণ ওমে মুখ গুঁজে শুয়ে থাকলো। শুয়ে শুয়ে শুনছিল রাখাল পাশের ঘরে লোহার আলমারি খুলে কি সব যেন করছে। কোন একটা বাক্সও যেন খুলল আবার বন্ধ করল । লোকটা তার স্বামী হলেও লোকটাকে সে একেবারেই বিশ্বাস করেনা। গত আঠারো বছরে এমন কোন ব্যবসা নেই যাতে রাখাল হাত দেয় নি। দুর্ভাগ্যবশত কোনটাতেই সে সফল হয়নি। এক রত্তি সোনা নেই আজ বাসন্তীর গায়ে, বাড়ি, জমি সব বন্ধক পড়ে আছে। ব্যবসা সূত্রে বাইরে কত ধার দেনা, বাসন্তীর মায়ের কাছ থেকেও কত বার টাকা নিয়ে এসেছে রাখাল, তার কোন হিসেবই নেই। বাসন্তীর কয়েকটি টিউশনিতে সংসারটা চলছে। সন্তান নেই তাদের, হয়নি, এটাই বাঁচোয়া।

দুপুরে রান্না করে খেতে ডাকল রাখালকে । সে তখন গভীর ঘুমে। কোন মতে উঠে স্নান করে, নাকে মুখে গুঁজে, গরম কোট আর মাথায় মাফলার পেঁচিয়ে রাখাল কোথায় যেন যাবার জন্য তৈরি। লোকটার এত লোকসান, তবু একটুও দমেনি। গত কয়েক মাস ধরে আবার কি এক হুজুগে মেতেছে। এখনও খোলসা করে কিছু বলেনি, তবে কয়েকদিন ধরে বেশ ভাবনা চিন্তায় আছে, সেটা বোঝা যায়। গত মাসে বাসন্তীর মায়ের কাছেও কয়েকবার হানা দিয়েছে। বাবা শুধু বাড়িটুকুই ছেড়ে গিয়েছিলেন। বাড়ির একটা অংশ ভাড়া দিয়েই মা এতকাল চালিয়েছে । নিরক্ষর তার মা তাদের তিন বোনকে পড়াশোনা করিয়েছে, যথাসাধ্য বিয়েও দিয়েছে। আজ সকাল থেকে রাখালের হাবভাব একটু অন্য রকম। ভীষণ চুপচাপ। বাসন্তী তাই বিশেষ ঘাঁটাল না।

বিকেলে পাঁচটায় পাশের বাড়িতে টেলিফোন। ওরাই ডেকে দিল । মেজদি লাইনে। মা আর নেই। রাতে মাকে বাসন্তীর বাড়িতেই নিয়ে আসা হল। রাখাল তখনও ফেরেনি। সকালেই দাহকার্য করা হবে। বড়দিদের খবর দেওয়া হয়েছে, ছোট মাসিরাও রাঁচি থেকে রওনা দিয়েছে । শীতের রাত, পাড়া পড়শি কেউই বেশীক্ষণ বসলো না। মায়ের মাথার কাছে রাখা প্রদীপটা উস্কে দিয়ে বাসন্তী মায়ের কাছে বসলো । মার গলার কাছে মালা দেবার সময় সাদা চাদরটা একটু সরে গিয়েছে, হাত দুটো বুকের কাছে জড়ো করা। চাদরটা টেনে উপরে তুলে গিয়ে বাসন্তী একটু চমকে গেলো, মার বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলে হাল্কা নীলচে রঙের ছোপটা কিসের? কেন ?

বাড়ির বাইরে আধো অন্ধকারে মেজ জামাইবাবু আরও কিছু পুরুষ মানুষ জটলা করে দাঁড়িয়ে কথা বলছে, আহত বাসন্তী তাদের মধ্যে এখন রাখালকে খুঁজছিল। 


No comments:

Post a Comment

Facebook Comments