html

Saturday, April 28, 2018

মৌমিতা মিত্র

তারকোভস্কির ঘরবাড়ি 

মৌমিতা মিত্র


‘ছ্যাঁকা’ থেকে ছ্যাঁক মুছে যাবার পর যে ‘আ--হ’  জুড়ুনিটা আসে-বিয়ে,আনকোরা প্যাকেটে মোড়া স্বামীর হাত ধরে কলকাতা থেকে উত্তর ভারতের ঝাঁ চকচকে মলমোহিত শহরটিতে জুড়ে বসার পর সেই জুড়ুনি এল মনে। হাঁফ ছাড়লাম। সঙ্গে খানিকটা জলচোখ। একটা আস্ত কলকাতাকে উদোম রেখে এক ঘোমটায় গাঁওনি’ হয়ে গেলাম। কেবল বড় বড় মোটা মোটা ভি আই পি তে ‘ক’ এর শুঁড় ‘ল’এর লকলক, ‘কা’ এ কান্না। ‘তা’ এ তারকোভস্কি।

আমার পাগল দুই বন্ধু, যাদের সঙ্গে একটা এগরোলের সাড়ে তেত্রিশ শতাংশ সাবাড় করতাম দেশপ্রিয়র  ফুটে আর  আকাশ আমাদের দিকে চেয়ে ভাবত কবে শালা এদের পায়ে গড়াগড়ি খাব সেই ছন্ন ছিন্ন মস্তানদের থেকে  বিয়েতে উপহার পাওয়া  ‘তারকোভস্কির ঘরবাড়ি’ তে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়লাম।   

একটা পাগলাঝোরা
আতঙ্ক শিয়র উত্তেজনা
গোধূলির গলগল
জোনাক-ঝমঝম

        ছোটবেলা থেকেই এমনি সৃষ্টিছাড়া আমার মন- কেমনের সংসার। ছোট টিফিনের পর সবাই কেমন মন দিয়ে গোরু- মোষ খেদিয়ে বেড়াত, আমি কেবল হেড ডাউন করে ছোট মাঠটার উপর মশারির মত মেঘের ঝুলে পড়া দেখতাম, ঘাসেদের ঘনত্ব মাপতাম। আলোর  সংসার কেমন গুটিয়ে  ছোট হয়ে আসত। ঘাসগুলো আকাশের দাঁড়ি।  বড় টিফিনে সবাই যখন কানামাছি হয়ে ভোঁ ভোঁ করত আমি তখন রামধনুর দিকে ড্যাবা ড্যাবা মেলে  নট নড়ন, নট চড়ন। শেষটায় পাতা নড়ত; জল পড়ত। এই তাবৎ সংসারে আমি একদিন থাকব না কিন্তু  আকাশটা থাকবে রামধনুটা সময়মতোই ঝিকিয়ে উঠবে, এই মাঠ থাকবে সাদা নীল লুকোচুরি মেয়েরা  বোগাস বোগাস ছুটবে, তাদের মধ্যে কি কোন একটা  গেরেম্ভারী মেয়ে তখনও খেলা ফেলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকবে ঐ রঙ্গীন নাটুকেপানার দিকে আর ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাবে গোলাপী সংলাপে? 

তো, হল কি, সেই গোলাপী একটু একটু করে আমার গালে, চিবুকে,  চিকুরে, যোনি মলাটে রেণু রেণু হল আর  আমি গলগলে ধোঁয়াভর্তি মাথায়  লেপের তলায় একলা পুড়তে পুড়তে বড় হয়ে গেলাম।   

এখন, কথা হল তার সঙ্গে  তারকোভস্কির সম্পর্ক কি? সম্পর্ক সেই গোলাপিত্বের। আমার সেই অনন্যগহন – যেখানে পাতা নড়ে জল পড়ে  সুনামি হয় তারপর নতুন অন্ড ব্রহ্ম মনুত্বে মাথা তোলে কিংবা কল্প ভ্রষ্ট হয়  ঠিক  সেইখানটিতে  তারকোভস্কি  ফেললেন একটি নান্দনিক নোঙ্গর।

বার্গম্যানের ঘড়িতে কাঁটা ছিল না । সালভাদর দালির ঘড়ি এলিয়েছিল গাছে কিন্তু তারকোভস্কির কোন ঘড়ি নেই, আছে শুধু শ্যাওলা। সেই শ্যাওলার খাঁজে খাঁজে  জীবাশ্মের কারুকাজে করুণ কোলাজ। তারকোভস্কির জায়মানতা ছলোছলো থেকে ছপছপ ছাপিয়ে সমুদ্দুর। সাঁতার কাটতে কাটতেই তো আমরা আসি।  ছিঁড়ে বেরোই মায়ের গর্ভ যে মা- বাবার জন্য বসে থাকে অপেক্ষায়; বাবা ফেরে না। তারকোভস্কির বাবা। অগস্ত্য কবি ফেরেন নি আর।  মায়ের কপালে ঘামের ফোঁটা যম দুয়ারে পড়ল কাঁটা বালাই ষাট। মায়ের কি পালালে চলে। ছায়ের হাঁ এ খড়কুটো কে দেবে?

এক ‘মিরর’ এই কতরকমভাবে  নারীকে দেখেছেন। যে মা প্রতিমুহুর্তে নিজের ও পুত্রের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনিশ্চয়তায় ভোগেন, তিনিই আবার অন্য আয়নায় ছিন্নমস্তার অপরূপ এলোকেশী পাগলামিতে মনে ছ্যাঁৎ ধরিয়ে দেন। তারকোভস্কির নারী শুয়ে থাকেন বিছানা থেকে এক স্বর্গ উপরে।তার কুলকুন্ডলিনী নেমে আসে বিছানায় কিন্তু স্পর্শ করে না শয্যাকামুক। তার মাথার উপর দিয়ে উড়ে যায় মোক্ষকামী  শ্বেত কপোত অবিদ্যার দ্বার থেকে জোছন আলোকে।

তাঁকে দেখে বুঝেছি, জল-বৃষ্টির দেবতা ইন্দ্র নয়, তারকোভস্কি। প্রতিটি টিপ প্রতিটি টুপ যেন বিগ্রহে বিরাজে তাঁর সিনেমায়। সচন্দন গন্ধপুষ্পে ভরে ওঠে মন তাঁর টাপুরারতিতে।

প্রতিটি অণু কাদামাটি টুকরো পাথর পুজোর থালায় নিবেদিত প্রাণ। তাঁর দেশে আগুন ঝরে জল জ্বলে যায়। আসলে সীমার অপারে কারোরই কোন চরিত্র থাকে না বা মহানুভব মহৎকে  নিজ নিজ চরিত্র দান করে।

আমরা শুধু সীমান্ত যাপনে ‘স্টকার’ এর মত নুনের সমুদ্রে থমকে দাঁড়াই, লোনালীন হতে হতে মোক্ষম বা মোক্ষের দোরগোড়ায় এসে ভম্ব কিংবা হত হয়ে বসে থাকি অতীত ভবিষ্যৎ  আর আমি, আমরা তিনজন। থ্রি ইডিয়টস। তিন ইয়ার। মহামায়ান পিয়াসে কাষ্ঠ মারে জিভ। বোতল আসে না। বৃষ্টি আসে ঝেঁপে।

8 comments:

  1. তারকোভস্কির বিষাদমিশ্রিত রঙ রঙ কল্পখেলা চিনিয়েছিল আমার এক ইউরোপীয় বন্ধু। আজ অন্য এক জন তারকোভস্কির দু এক মূহূর্ত ছুঁয়ে নিলাম তোর লেখায়।

    ReplyDelete
  2. Replies
    1. ধন্যবাদ দাদা। দু জায়গায় লেখা যে দেখেছেন, তা ইচ্ছাকৃত ।

      Delete
  3. তারকোভস্কিরে তারে তারে সুর বাদ্য ছিনিয়ে, এ এক নিরিবিলি গোলাপীর, পাগল করে দেওয়া ধ্রুব বিষাদের, জমাট-জম মন ছোঁয়া।

    ReplyDelete

Facebook Comments